মুখোমুখি
মাস খানেক আগে কেনা গাড়িটা চালিয়ে অসীম অফিসের পার্টি থেকে বাড়ি ফিরছে,সে একটা নাম করা সফ্টওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করে,সেই কোম্পানির বস্ এর বিবাহ বার্ষিকীর পার্টি তেই গিয়েছিল সে।এমনিতে সে মদ না খেলেও কলিগ রা জোর করায় বেশ কয়েক পেগ বিলিতি মদ উদরে ঢেলেছে সে, এতক্ষন সেই মদের নেশার রেশ না পেলেও এখন গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বেশ টের পাচ্ছে।বাড়ির দিকে বেশ অনেকটা পথ চলে এসেছে সে আর মিনিট পনেরোর মধ্যেই বাড়ি পৌছে যাবে।তবে সামনের দিক কার রাস্তাটা বেশ অন্ধকার সেখানে একটা মোড়ের মত রাস্তা থেকে একটু দূরেই কয়েকটা বড় বড় বাড়ি,দূরের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে শুধু এটুকুই দেখা যাচ্ছে, আর একটু যেতেই অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ছে না অসীমের,তখন তার হঠাৎ চোখ পড়ল তার গাড়ির সবুজ আলো জ্বলা ঘড়িটার দিকে সেখানে সময় দেখাচ্ছে রাত সাড়ে বাব়োটা,তখন সে ভাবল এত রাতে এই অন্ধকার রাস্তায় কোনো মানুষ থাকবে বলে তার মনে হয় না, তাই সে তার গাড়ির স্পিড টা 50 থেকে বাড়িয়ে সোজা 80 করে দিল,আর পিছনে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল পার্টি থেকে ফেরার সময় যেই মদের বোতল আর কষা মাংস গুলো নিয়ে এসেছিল তা ঠিক ঠাক আছে কি না। তখনি কি যেন একটা গাড়ির ডান দিকের চাকার নীচ দিয়ে সজোরে বারি লেগে ছিটকে গেল,তখন তার মনে হল যে গাড়ি থামিয়ে একবার নেমে গিয়ে দেখবে যে,তার গাড়ির নীচে কী পড়ল,সেই মত গাড়িটাও স্লো করল,কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল এত রাতে এই অন্ধকার রাস্তায় নামা মোটেও নিরাপদ হবে না আর এত রাতে কোনো কুকুর ছাড়া অন্য কিছু তার গাড়ির তলায় পড়বে বলে তার মনে হল না, তাই সে তার গাড়ির গতি আবার বাড়িয়ে দিলো। পাঁচ মিনিট পরেই তার গাড়িটা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেল, তবে এখন সে অন্ধকার পথ পাড় করে অনেকটাই দূরে চলে এসেছে।গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির সামনের এই তার ঐ তার ধরে নাড়াচাড়া করতে লাগল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না,তারপর সে বুঝল যে এই গাড়ি ঠিক হবার নয়।
তারপর তার হঠাৎ চোখ পড়ল যে একটু সামনেই একটা ধাবা খোলা আছে,হাটতে হাটতে গেল ওই ধাবায়,তখন সেখানে গিয়ে দেখল যে একটা বেশ মোটাসোটা,বড় গোফওয়ালা লোক খালি গায় চেয়ারে বসে আছে আর খাতার মধ্যে কী যেন হিসাব করছে,অসীম মনে মনে ভাবল যে এই লোকটাই হয়ত ধাবার মালিক, গিয়ে লোকটাকে বলল ''দাদা আশেপাশে কি কোন মেকানিক পাওয়া যাবে,আসলে খুব বিপদে পড়েছি,ঐ যে আমার গাড়িটা দেখছেন,স্টার্ট নিচ্ছে না।'' লোকটা মাথা বাড়িয়ে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল ''হ্যাঁ,মেকানিক একটা আছে বটে কিন্তু ঐ ব্যাটা তো এতক্ষণে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে, তবে আপনি যখন এত করে বলছেন,আমি লোক পাঠিয়ে ওকে ডেকে পাঠাচ্ছি, ততক্ষন আপনি ভেতরে গিয়ে বসুন।''তখন অসীম ভেতরের দিকে গেল।তখনই লোকটা জোরে ডাকল ''ছোটু,ঐ ছোটু'' সাথে সাথে একটি বছর পনোরোর ছেলে তার সামনে দিয়ে মালিকের কাছে গেল, তারপর মালিক ছোটুকে কি যেন বলল যা অসীম দূর থেকে ভালো শুনতে পেল না, কিন্তু ছোটু যখন মালিকের দেওয়া টর্চ টা নিয়ে রাস্তার দিকে গেল তখন সে বুঝল যে,মেকানিক কে ডাকতেই সে গেল।
এরপর অসীম ভিতরের দিকে তাকিয়ে দেখল যে ধাবায় প্রায় 20 টার মতো টেবিল আছে, আর তার প্রায় সবকটাতেই লোক বসে আছে, কেউ খাচ্ছে আবার কেউ গল্প করছে, সম্ভবতঃ এরা সবাই বাইরে যে ট্রাকগুলো আছে সেগুলোর ড্রাইভার। সে তখন দেখল যে একেবারে পেছনের দিকে,কোনায় একটা টেবিল ফাকা আছে সে ওখানে গিয়ে বসল।বসে বসে সে পকেট থেকে তার মোবাইল টা বের করে ঘাটাঘাটি করতে লাগল, কিছুক্ষণ পরেই তার চোখ দুটো ঘুমে বন্ধ হয়ে এল,আর টেবিলের উপর মাথাটা নামিয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।মিনিট পাচেক পরেই হঠাৎ তার মনে হল কে যেন তার সামনের চেয়ারটায় এসে বসল তখনই তার ঘুমটা ছুটে গেল, সে চোখ দুটো খুলতে খুলতে উঠে বসল আর দেখল সামনের টেবিলে এক ভদ্র লোক বসে আছে,আর তার দিকে একনজরে তাকিয়ে আছে, লোকটির কপালে একটা দাগ আছে,বয়স অসীমের মতই হবে, কিন্তু লোকটার চোখ দুটো তার খুব চেনা,কিন্তু সে কিছুতেই মনে করতে পারছেনা লোকটাকে কোথায় দেখেছে।লোকটা এখনও তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে লোকটাকে জিগ্গেস করল "কি? কিছু বলবেন?"
লোকটিও একগাল হেসে জবাব দিল"আচ্ছা আপনার নামকি অসীম চৌধুরী?আপনি কি মডার্ন হাইস্কুলে পড়তেন?"
অসীম বলল "হ্যাঁ"
সঙ্গে সঙ্গে অসীমের চোখ গেল লোকটার ডানদিকের গজ দাতটার দিকে আর তখনই যেন তার সারা শরীরে বিদ্যুত খেলে গেল,কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম বেরিয়ে এল, আর মনে পড়ে গেল স্কুলের সেই ছেলেটার কথা যে আজ 15 বছর পর তার সামনে বসে আছে, মোটা হওয়ায় আর চুল বড় হওয়ায় তাকে চিনতে পারেনি সে ,লোকটার নাম নিখিল নিয়োগী,তার সাথেই স্কুলে পড়ত, আর তার আরও মনে পড়ল স্কুলের সেই দিনটার কথা,
তারা তখন ক্লাস 11 এ পড়ে,আর নিখিল তার নতুন ক্যামেরা ওয়ালা মোবাইল টা নিয়ে স্কুলে এসেছে, আর সেটা দেখাতে নিয়ে গেছে তার বন্ধু অসীম কে। তবে আজ ফোনটা নিয়ে আসার অন্য একটা কারন আছে কারন অসীমের ইচ্ছে যে মোবাইল টা সেট করবে মেয়েদের বাথরুমে আর এমন জায়গায় রাখবে যাতে সেটা কারও চোখে না পড়ে কিন্তু সেই মোবাইলে যেন সব রেকর্ড হয়।নিখিল বার বার বারন করা সত্ত্বেও অসীম কিছুই শোনেনি
সে শুধু বলেছে "যে তুই কোনো চিন্তা করিস সব আমিই তো করব"।
যেমন কথা তেমন কাজ অসীম মোবাইল টা স্কুল শুরু হবার সময়ই মেয়েদের বাথরুমে রেখে আসে, কিন্তু সবসময় কি সব প্ল্যান পূর্নতা পায়? ঘন্টাখানেক পরেই একটা মেয়ে দেখে ফেলে সেই ক্যামেরা,সাথে সাথে নিয়ে যায় হেডমাস্টারের কাছে।হেডমাস্টার জানতে পারে যে মোবাইল টা নিখিলের, ডেকে পাঠায় তাকে, তারপর আসে পুলিশ, কিন্তু সে বারবার বলার চেষ্টা করে যে একাজ সে করেনি ,কিন্তু কেউ তার কথা শোনার প্রয়োজন মনে করেনি, পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যায়,সেখানে তাকে পুলিশ খুব মারে,সেদিনের কপালে মারের দাগটা এখনও আছে,পরে যখন তাকে আদালতে তোলা হয়, সেখানে অসীম ও যায়, তাকেও জেরা করা হয় কিন্তু সে তার দোষ অস্বীকার করে। বিচারে নিখিলের জেল হয়। তারপর অসীম আর তার খোঁজ করেনি।অসীম প্রায় মিনিটখানেক ধরে এসব ভাবছিল কিন্তু নিখিল তাকে জোরে বলে উঠল "কী রে আমাকে চিনতে পারিস নি"
অসীম জবাব দিল "হুম, পেরেছি, তা কেমন আছিস বল?"
নিখিল বলল"যেমন রেখেছিস"
"অনেক দিন তোর কোনো খবর পাই নি, জেল থেকে ফিরে কী করেছিস? "অসীম বলল।
নিখিল জবাব দিলো "ঐ তো একটা ব্যবসা শুরু করেছিলাম, টাকাও অনেক কামিয়েছিলাম, কিন্তু জুয়ার নেশা জেল থেকে লেগে গেছিল, তাতেই সব শেষ, কদিন আগেই বাড়িটাও নিলাম হয়ে গেছে, এখন এদিক ওদিক ঘুরে বেরাই।আমার কথা বাদ দে, তোর খবর বল"
অসীম বলল, "বছর দশেক হল একটা সফ্টওয়্যার কোম্পানি তে কাজ করছি।তুই বিয়ে করিস নি?"
নিখিল বলল "না,তুই?"
উত্তর এল"করেছিলাম,এখন ডিভোর্স হয়ে গেছে"
নিখিলের হঠাৎ চোখ দুটো লাল হয়ে গেল, আর তার মুখে একটা দারুন রকম খুশির হাসি ফুটল,আর বলল"আমার জীবনটা শেষ করে,নিজেও খুশি হতে পারিস নি তাহলে"অসীমের চোখ দুটো জলে ভরে গেল আর বলল"তুই চল আমার সাথে, আমার বাড়ি, আমাকে একটা ভুল শোধরাবার সুযোগ দে।"নিখিল অট্টহাসি দিয়ে বলল "সে সুযোগ তো তুই নিজেই হারিয়েছিস রে,গাড়ির চাকায় যে পিশে আমাকে শেষ করে দিয়েছিস।"
অসীম বলল " কী সব আলফাল বকছিস, কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা। "
নিখিল বলল "বুঝতে চাইলে টেবিলের নীচে আমার পা দুটো দেখ"
অসীম সেই মত টেবিলের নীচে তাকিয়ে দেখল নিখিলের কোমরের নীচ থেকে একেবারে থেতলে গেছে,শুধু কালো কালো রক্ত। সে বুঝল অন্ধকার রাস্তায় যাকে গাড়ি দিয়ে ছিটকে দিয়েছিল সে আর কেউনা সে হল নিখিল। যখন টেবিলের নীচ থেকে উঠে উপরে উঠল দেখল সামনের টেবিলটা ফাঁকা কেউ নেই এই দেখে সে অচেতন হয়ে টেবিলের উপর পড়ে গেল। কিছুক্ষন পরে যখন তার জ্ঞান ফিরস তখন সে চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে এদিক ওদিক নিখিল কে খুঁজতে লাগল।তখন ছোটু তার সামনে দিয়ে গেল কিন্তু তাকে না দেখার ভান করে তার টেবিল টার দিকে চলে গেল আর কাকে যেন বলতে লাগল "স্যার,ও স্যার উঠুন গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে।"
অসীম এগিয়ে গেল ঐ টেবিল টার দিকে আর যা দেখল তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ।সে দেখল তার মতন দেখতে একটা লোক টেবিলের উপর পড়ে আছে আর তাকে ছোটু শুধু ডেকেই যাচ্ছে কিন্তু সে উঠছে না।এরই মধ্যে ছোটুর আওয়াজ শুনে তার মালিক সেখানে আসে আর অসীমের শরীরের মধ্যে দিয়ে ভেদ করে টেবিলের উপর থাকা দেহটার নাড়ি টিপে বলে "মালটা, টিকিট কেটেছে"
তখন অসীম বুঝতে পারে যে সে আর মানুষ নেই,নিখিলের পা দেখে ভয় পেয়ে হার্টফেল করে আত্মায় পরিনত হয়েছে।
সমাপ্ত
সম্পূর্ন গল্পটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
No comments:
Post a Comment